মিশেল ওবামা—মার্কিন ফার্স্ট লেডি। জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। বোয়ি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি ২০১৩ সালের ১৭ মে এই বক্তৃতা দেন।
ধন্যবাদ! আজ এখানে তোমাদের সঙ্গে থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছি। তোমরা জানো না, আমরা সবাই তোমাদের নিয়ে কতটা গর্বিত। আমি জানি, তোমাদের এ যাত্রা সহজ ছিল না। এমন অনেক সময় এসেছে, যখন দ্বিধা আর হতাশার মধ্য দিয়ে তোমাদের যেতে হয়েছে।প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ দেশের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শিক্ষা অবৈধ ছিল। কোনো ক্রীতদাস যদি পড়তে বা লিখতে গিয়ে ধরা পড়ত, তার শাস্তি ছিল অবর্ণনীয়। আর কেউ যদি তাদের লেখাপড়া শিখতে সাহায্য করত, সে কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ যা-ই হোক না কেন, তার কপালে জরিমানা বা জেল জুটত। কিন্তু তার পরও দাসপ্রথা বিলোপের দুই বছরের মাথায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু আফ্রিকান-আমেরিকানদের শিক্ষিত করতেই নয়, বরং তাদের শেখাতে, কীভাবে অন্যদের শিক্ষিত করতে হয় এই হচ্ছে বোয়ি স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস। আর আজ তোমরাও সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলে। এই গৌরবের সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের কাঁধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও এসে পড়েছে। আজকে আমি তোমাদের সঙ্গে এটি নিয়েই কথা বলতে চাই। একটু পেছন ফিরে তাকালেই আমরা দেখব, যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখানে কাদামাখা মেঝে আর ছিদ্রওয়ালা ছাদের কয়েকটি কাঠের কুঠুরির বেশি কিছু ছিল না। ব্ল্যাকবোর্ড, মানচিত্র এমনকি বইও ছিল বিলাসিতা! শিক্ষক আর শিক্ষার্থী—সবাইকেই অনবরত হুমকির মুখে থাকতে হতো। সেসব মানুষের জন্য শিক্ষা শুধু লিখতে আর পড়তে পারার চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। যেমনটি ফ্রেডরিক ডগলাস বলেছেন, ‘শিক্ষা মানে মুক্তি। এর মানে আলো আর স্বাধীনতা। এর মানে নিজের আত্মাকে সত্যের আলোয় আলোকিত করা, একমাত্র সে সত্যই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।’
সেই সময় মানুষ শিক্ষার জন্য ব্যাকুল ছিল। এ দেশে সফল হওয়ার জন্য যা দরকার ছিল, তার জন্য তাদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ আকাঙ্ক্ষা কমে যায়নি, বরং বেড়েছে। শত বছর ধরে এ দেশে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা ভেবে দেখো। থারগড মার্শাল ও মার্টিন লুথার কিং অনেক বাধা-বিপত্তি, হুমকি আর ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আন্দোলন করে গেছেন। একবার রুবি ব্রিজেসের কথা ভেবে দেখো। কোনো শ্বেতাঙ্গ স্কুলে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী এই মেয়ের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। তাকে ভর্তির প্রতিবাদে অন্য শ্বেতাঙ্গ মা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। লোকজন রুবির পরিবারের পেছনে লেগেছিল। তার বাবা চাকরি হারিয়েছিলেন। সারা স্কুলে কেবল একজন শিক্ষক তাকে পড়াতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু রুবির পরিবার পিছু হটেনি। একটি বছর ধরে ছোট্ট রুবি ক্লাসে একলা বসে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছিল।
অসংখ্য মানুষ এ রকম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, শিক্ষা লাভের জন্য কী তীব্র ইচ্ছাই না ছিল তাঁদের! শিক্ষা তাঁদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই জীবন-মরণের ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজকে যখন শিক্ষার কথা ওঠে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম অতটা পাত্তা দেয় না। সেদিনের মতো আজ আর স্কুলে যাওয়ার জন্য কাউকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় না। তবু তারা স্কুলে না গিয়ে ঘরে সোফায় শুয়ে ভিডিও গেম খেলে বা টিভি দেখে। একজন শিক্ষক, আইনজীবী বা সফল ব্যবসায়ী হওয়ার বদলে তারা র্যাপ গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পেশা হিসেবে যা-ই বেছে নাও না কেন, তোমাদের প্রত্যেকেই তরুণ প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। তোমার কোনো বন্ধু, আত্মীয় বা ভাইবোন যদি লেখাপড়াকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেয়, তাদের ভুল ধারণা ভেঙে দাও। তাদের সঙ্গে কথা বলো। তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনো।
যদি তোমার এলাকার স্কুলটি ভালো না হয়, এটিকে মেনে নিয়ে বসে থেকো না। এটিকে ঠিক করো। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলো। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলো, এলাকার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর নেতৃস্থানীয় মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করো। একটি স্কুলকে শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে আমাদের সবার ভূমিকা আছে। আর যখন তোমাদের নিজেদের সন্তানের প্রসঙ্গ আসবে, তারা টিভিতে যা দেখবে, সেটি যদি ভালো কিছু না হয়, তাহলে টিভি বন্ধ করে দাও। তারা যে ভিডিও গেমটি খেলবে, সেটি যদি তোমার ভালো মনে না হয়, সেটি কেড়ে নাও। সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সারাক্ষণ সেলিব্রেটিদের গুজব প্রচারকারী গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নাও। যে সংস্কৃতি পরিশ্রম ও ধৈর্যের বদলে ক্ষণস্থায়ী সাফল্যকে বড় বলে শেখায়, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।
সোজা কথায়, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলো, আর সুশিক্ষার শক্তি সম্পর্কে তাদের অবগত করতে নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করো। কারণ, আমার আর আমার ভাইয়ের জন্য আমার মা-বাবা এটিই করেছেন। তাঁরা নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি। কিন্তু আমাদের এই সুযোগ দিতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আমার বাবা অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রতিদিন নিয়ম করে চাকরিতে যেতেন, কিন্তু কোনো দিন তিনি এটি নিয়ে বিন্দুমাত্র অভিযোগ করেননি। একটিবারের জন্যও না। আমার ও আমার ভাইয়ের পড়াশোনার খরচের একটা বড় অংশ শিক্ষাঋণ আর অনুদান থেকে আসত, তার একটি ছোট্ট অংশ আমার বাবা পরিশোধ করতেন। অর্থের অভাবে আমরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারব না, এমনটি ভাবাও বাবার জন্য অকল্পনীয় ছিল। আজ এমন একটি দিনও যায় না, যে দিনটিতে আমি আমার মা-বাবার এই ত্যাগের কথা মনে করি না। এমন একটি দিনও নেই, যে দিনটিতে তাঁদের এই দৃষ্টান্ত আমাকে নাড়া দেয় না।
আজকে আমি আমার মা-বাবার মতো আরও অসংখ্য মা-বাবার কথা ভাবছি, যাঁরা অতিরিক্ত কাজ করে, একটু বেশি পরিশ্রম করে তাঁদের সন্তানদের বেশি কিছু দিতে চেয়েছেন। তাঁদের এই ত্যাগের বিনিময়েই এসেছে তোমাদের অর্জন। নতুন প্রজন্মের জন্য এই আলোর মশাল বহন করার আর পথ দেখানোর দায়িত্ব তোমাদেরই। আমি তোমাদের সাফল্য কামনা করি।